ভালবাসা সীমাহীন
↓↓↓
১।
সব মেয়ে ঘুমানোর আগে চুল বেধে ঘুমায়, এই মেয়ে রাতে চুল খোলা রেখে ঘুমায়। মেয়েটিকে নিয়ে আমার সারাদিন কোন অনুভুতিই কাজ করেনা, রাতে শুধু ঘুমাতে পারিনা, কারন এই মেয়ে রাতে চুল খুলে ঘুমায়,আমার চোখে তখন ঘোর লাগে।
.
মেয়েটির সাথে আমার বিয়ের তেরো দিনের মাথায় ওকে এখানে নিয়ে আসি। বিয়ের পরের সাতদিন বাবা মার সাথে ছিলাম, এরপর এখানে চলে আসা। আমার ইচ্ছে ছিলনা ওকে নিয়ে আসার, কিন্তু বাবা মা কথা শোনেননি আমার। তারা চায় ছেলে একা একা অনেক কস্ট করেছে খাওয়া থাকা নিয়ে, এখন আর না। বাধ্য হয়ে ওকে এখানে নিয়ে আসা। ওর সাথে আমার বিয়ে হয় মা বাবার ইচ্ছেতেই।
.
দেখতে গিয়ে ওর মধ্যে আহামরি আমি কিছুই পাইনি। গায়ের রং শ্যামলা, খুব সাধারন একটা সালোয়ার কামিজ পড়া ছিল, চুল বেনী করে রাখা, মুখে ক্রিম পাউডারের কোন অস্তিত্ব নেই, ত্বক মোলায়েম নয় আমি তা দূর থেকেই বুঝতে পারছিলাম। আমার ভালো লাগেনি কিছুই। কিন্তু মা বাবা কিভাবে এই মেয়েকে যেন পছন্দ করে ফেললেন। আমি না করেছিলাম, কিন্তু তারা আমার পিছ ধরেই রইলেন দিন দিন। অবশেষে তাদের ইচ্ছার কাছে হার মেনে নিলাম। আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।
আজ পর্যন্ত আমরা কাছাকাছি হইনি, আমার ইচ্ছে করেনি, মেয়েটির মধ্যেও আমি সেরকম কোন ইচ্ছে দেখিনি।
.
২।
সারাদিন অফিস করি, সন্ধ্যায় বন্ধু কলিগদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে, টিভিতে নিউজটা দেখে ঘুমাতে চলে যাই, সকালে নাস্তাটা সেরেই আবার বেড়িয়ে পড়ি।ওর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা হয়না। ছুটির দিনে আমার সকালে অনেক্ষন ঘুমানোর অভ্যেস, এই মেয়ে আমাকে ছুটির দিনেও রোজকার মত সকালে ডেকে নাস্তার জন্য বলে, আমার বিরক্ত লাগে, মনে হয় এক ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখি, পারিনা তাই মনের ইচ্ছা মনেই চেপে যাই। আমি এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি টেবিলে খাবার সেভাবেই পড়ে আছে, তার মানে এই মেয়েও খায়নি। মনে মনে ভাবি এতো ভালো আপদ গলায় ঝুলেছে! আমি নাস্তা করে, বারান্দায় সিগারেট ধরাতে গিয়ে দরজার ফাকে দেখি মেয়ে রান্নাঘরে খাচ্ছে। আমি ভাবি সিনেমেটিক ন্যাকামো।
ছুটির দিন গুলো অসহ্য ঠেকে আমার কাছে। আমার টিভি দেখার খুব নেশা নেই, ঘুম থেকে দেরীতে ওঠার কারনে দুপুরে ঘুমও আর আসেনা।
কি করবো বুঝিনা। আগে ছুটির দিনে বাড়ি চলে যেতাম, এখন মেয়েটিকে একা রেখে যাওয়া যাবেনা বলে বাড়িও যাইনা, ওকে নিয়ে যেতেও ইচ্ছে করেনা।এই মেয়েও আনইজি ফিল করে বোঝা যায়, টুকটাক কাজের বাহানায় দুরে দুরেই থাকে।তবু আমার বিরক্ত লাগে মনে, উটকো ঝামেলাই মনে হয়।
.
৩।
সেদিন সকালে অফিসে বের হবার সময় ও বলে, চাল নেই। দুপুরে হবে কিনা জিজ্ঞেস করি আমি, বলে দুপুরের রান্নার জন্যও হবেনা। রেগে গেলাম, চাল নেই এখন কেন জানাচ্ছে কাল জানায়নি কেন! চিবুকটা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ভুলে গিয়েছিলাম। বলে ওভাবেই দাড়িয়ে রইলো। আমি বের হয়ে গেলাম, রাগ নিয়েই, চাল কিনে আবার বাসায় আসবার সময় আমার নেই। ভাবলাম, না খেয়েই থাকুক একবেলা না খেলে কিছু হয়না। মনে খচখচানি ভাব রয়েই ছিল। সারা সকাল কাঠফাটা রোদের পর হঠাত করেই দুপুরের পর আকাশ মেঘলা হয়ে এল। অফিসে চাপটাও কমে এল, তাই সেদিন তারাতারিই বেরিয়ে গেলাম। চাল কিনে বাসায় জলদি ফিরে গেলাম। দরজায় বারবার নাড়া দিয়ে ভেতর থেকে কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা, আমার কাছে লক খোলার এক্সট্রা চাবি থাকে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি মেয়ে গভীর ঘুমে, সেই খোলা চুল, এলোমেলো শাড়ি। ইচ্ছে করে খুক খুক কাশি দিই আমি, ও ধরফর করে উঠে বসলো। এলোমেলো শাড়িটা কোন মতে থুপথাপ করে উঠে দাড়াতেই, মাথাটা চেপে আবার বিছানায় বসে পড়লো। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সামান্য নাকি জ্বর। চোখ দেখে মনে হলোনা জ্বরটা সামান্য। বাসায় থার্মোমিটার নেই, জ্বর কতটা ওষুধ লাগবে কিনা বুঝতে বাধ্য হয়েই কপালে হাত দিতে হলো। এই প্রথম ওকে স্পর্শ করেই অবাক হলাম, ভীষন জ্বর! দুপুরে কিছু খেয়েছে কিনা জানতে চাইলাম, চুপ করে বসে রইল। আমার একই সাথে খারাপ লাগছে আবার বিরক্তও লাগছে। ওকে শুয়ে থাকতে বলে আমি কাপড় পাল্টে রান্না ঘরে ঢুকলাম, একা থাকার কারনে টুকটাক রান্নার অভ্যেস আছে আমার।
ভাতটা রেঁধে নিচে গিয়ে ওষুধ এনে দিতে হবে, ভাবতে ভাবতে ঝমঝমিয়ে বৃস্টি। দড়জা দিয়ে দেখলাম ও দৌড়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে বোঝার জন্য পিছু পিছু আমিও এগিয়ে গেলাম, দেখি সে ধপ ধপিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ছাদে কাপড়। কাপড় তুলে আধভেজা হয়ে ফিরে এল। কাপড়ের পরিমান দেখে আন্দাজ করতে পারলাম জ্বরের কারন। বাসার সব কাপড় ধুয়েছে বলে মনে হল। রাগ হল তখন। কাপড় ধুয়ে জ্বর বাধিয়ে বসে আছে তার সেবা করবে কে! ভাবলাম ঝারি দেওয়া দরকার, তার যেমন ইচ্ছে সে সেভাবে চলবে নাকি! রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখি সে রুমে নেই। বারান্দায় শান্ত ভংগিতে কাপড় নাড়ছে, চুল খোলা। আমার সেদিন দিনের আলোতেই ঘোর লাগলো। ওই একরাতই শুধু আমার রাধতে হয়েছিল, পরদিন থেকে জ্বর নিয়েই সে টুক টুক করে সব কাজ করতো, আমার কিছু বলার ইচ্ছে হয়নি, কাজ করতে পারলে করুক! আমার দায়িত্ব ছিল ওষুধ কিনে দেওয়া আমি দিয়েছি, আর জিজ্ঞেসও করিনি জ্বর আছে কি নেই।
.
৪।
বছরের শেষের দিনগুলোতে অফিসে চাপ খুব কম থাকে। অযথা অফিসে বসে থাকতেও ভালো লাগেনা। মাঝে মাঝে দুপুর দুপুরেই বাসায় ফিরে যাই। সেদিন চাবি দিয়ে নিজেই দড়জা খুলে ঢুকেছি। ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে মেঝেতে বসে একমনে পায়ে আলতা সাজাচ্ছে, আমি পাশে দাড়ানো টেরও পায়নি। সরে এসে সামনে দাঁড়ালে চমকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে উল্টে ফেলে আলতার বাটি। কি যেন কি বড় অন্যায় করে ফেলেছে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আমি হেসে ফেললাম,সেই হাসিতে সে অবাক হয় , আমিও অবাক হই। সেদিন বাকি সময় দুজনই চোখ এড়িয়ে চলার চেস্টা করছিলাম।
.
আরেকদিন বাসায় এসে দরজা নেড়ে কোন শব্দ না পেয়ে নিজেই দড়জা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি রুম ফাকা, বারান্দাতেও কেউ নেই। আমার ভয় হয়। অচেনা শহর মেয়েটা যাবে কই! আরো ভয় হলো যখন মাথায় ভাবনা এল, আমাকে ছেড়ে চলে গেল নাতো! বাসা থেকে বের হইয়ে সিড়ি দিয়ে নামছি তখন মনে হল ছাদটা একবার দেখে যাই। গিয়ে দেখি মেয়ে, বিল্ডিং এর সব বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কানামাছি খেলছে। বাচ্চারা ওর কোমড়ের পেছনে লেগেছে। মেয়েটার খুব বেশি সুড়সুড়ি। ওর হাসি থামছেনা। মেয়েটি এভাবেও হাসতে জানে! আমার ঘোর লাগে।
.
৫।
প্রতিদিন আমার জলদি জলদি বাসায় ফেরার ইচ্ছে হয়, দুপুরের পর থেকে অফিসের চেয়ারটা আর ভালো লাগেনা, বন্ধু কলিগদের আড্ডাও আর ভালো লাগেনা। বাসায় ফিরে আসি, অলস বসে থাকি আড় চোখে ওকে খুজে বেড়াই। ও আগের মতই দূরে দূরেই থাকে। আমিও কিছু বলিনা। মা বারবার ফোন করে বাসায় যেতে বলে অস্থির করে ফেললেন। সেই যে বিয়ের পর এলাম আর যাওয়া হয়নি। মনে হল যাওয়া দরকার তখন। শুক্র শনি বন্ধ, বৃহঃষ্পতিবার বিকেল বিকেল করে বের হয়ে গেলাম। বৃহঃষ্পতিবার মানেই ভীড়। বাসে পাশাপাশি ফাকা কোন সিট পেলাম না। ওকে এক মহিলার পাশে বসিয়ে দিয়ে আমি পেছনে আরেকজনের সাথে শেয়ারে বসেছি। যতবার বাস থামে ততবার চাতকের মত দেখি ওর পাশে বসা মহিলা নেমে যায় কিনা। অর্ধেক পথ তখন চলে এসছি, সিট ফাকা হতেই আমি দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে বসি। দেখি মেয়ে ঘুম, চুল কিছু ক্ষোপার বাইরে অবাধ্য উড়ছে। আমি চোখ বুজে মুচকি হাসি। এর মধ্যে টুপ করে ওর মাথা এসে কাঁধে পড়ে। আমার হৃতস্পন্দন বাড়ে, আমার ঘোর লাগে। কাধ ঝাকি দিয়ে জাগিয়ে দিতেই দেখি মেয়ে লজ্জায় চুপসে গেছে।
.
৬।
বাসায় সারাদিন লোক লেগেই রইলো, নতুন বউ অনেকেই দেখেনি তারা দেখতে এল। মা ছেলের বউকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিচ্ছেন না, বউকেও দেখি মায়ের পিছ ছাড়ার ইচ্ছে নেই। বিকেলে দেখি মা তেল দিয়ে দিচ্ছে মাথায়, ওর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ছে। পানি নিয়েই মার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। আমি লুকিয়ে দেখি আমার ঘোর লাগে। মা যখন ছাড় দেয় ও তখন অথৈ সাগরে পড়ে, আমার ঘরে এসে কি করবে বুঝতে পারেনা, আবার অন্য রুমে গিয়ে একা বসলে মা কি ভাববে সেটা ভেবে অন্য কোথাও যেতেও পারেনা। সন্ধ্যায় বারান্দায় গিয়ে দেখি উদাস তাকিয়ে আকাশের দিকে। আমি জিজ্ঞেস, মার বাসায় যাবে? ও চমকে ওঠে। আমি অন্ধকারেও টের পাই ওর চোখ চিক চিক করছে। আমার ঘোর লাগে। আমি ছুটি ম্যানেজ করি আরো একদিনের। বাড়িতে গিয়ে ওর কি উচ্ছাস! নিজের ঘরটাতে ঢুকে সে কি কান্না! আমি বুঝতে পারিনা কি করবো, হা করে চেয়ে থাকি। অবাক চোখে দেখি দেয়ালে ছবিগুলো, মায়বী মুখের ছবিগুলো। সারাদিন সে বাসায় ছুটোছুটি করে বেড়ায়, আর একটু পর পর কিছুনা না কিছুর বাহানায় ঘরে এসে ঘুরে যায়, আমার কিছু লাগবে কিনা বোঝার চেস্টা করে। আমি প্রতিবার তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
.
৭।
আমার ছুটি শেষ। সবাই বলছিল ওকে রেখে যাই যেন কিছুদিনের জন্য, আমি মুখে সায় দিচ্ছিলাম কিন্তু রাগ হচ্ছিল প্রত্যেকের উপর খুব। ও যদি রাজি হয়ে যায়, সেই ভয়ে আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে তখন। থাকতে রাজি হয়নি। ফিরতি পথে আমি চাইতে লাগলাম ও আবার সেদিনের মত ঘুমিয়ে যাক আর মাথাটা আবার আমার কাধে এসে পড়ুক। আমি বিচক্ষনে ওর একটু পাশে সরে আসতেই বুঝলাম ও কাঁদছে। আমার রাগ হল খুব, কেন কাদছে ও, আমাকে কি ভালো লাগেনা! যত পথ শেষ হয়ে আসছিল, মেঘ তত গভীর হয়ে জমাট বাধছিল আকাশে। ঘোর বৃস্টির মধ্যে বাস থেকে নামলাম আমরা। রিক্সায় উঠতে উঠতেই তখন ভিজে একাকার। হুড তুলে খুব পাশাপাশি দুজনে বসে আছি। তাতেও আমার রাগ কমছে না।
.
৮।
আমার বৃস্টি ভালো লাগেনা, ছোট বেলা থেকেই বৃস্টিতে ভেজার অভ্যেস নেই। বৃস্টির পানি মাথায় পড়া মাত্র আমার জ্বর ঠান্ডা ধরে বসে। সেদিনো ব্যাতিক্রম হলো না। হাড় কাপিয়ে জ্বর এল আমার। সেদিন বুঝতে পারলাম একটা মেয়ে কতটুকু মায়া তার ভেতরে লালন করে! জ্বরের পর থেকে মুহুর্তের জন্যও সে আমার পাশ থেকে সরেনি। আমার তাকিয়ে থাকতে কস্ট হচ্ছিল, তবুও যতবার চোখ খুলে তাকিয়েছি দেখেছি ও উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়েই আছে মুখের দিকে। ওর স্পর্শ আর উদ্বেগ পাওয়ার জন্যই মনে হয় আমার জ্বর আরো জেকে বসছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে জ্বর আরো বাড়লো, সব কিছু আস্বভাবিক, আলো চোখের পাতা ভেদ করে চোখে গিয়ে লাগছিল।
.
বেহুশের মত কতক্ষন পড়ে ছিলাম জানিনা, শেষরাতের দিকে যখন চোখ খুললাম আলো আর চোখে এসে বিধলো না। দেখি ঘরে মোম জ্বলছে।
ক্লান্তিতে চোখ খুলে রাখা খুব কস্টের তখন। চোখ বুজে মরার মতই পড়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম নরম হাত আমার কপাল বেয়ে বার বার চুলে হাত বুলাচ্ছে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি মায়ায়। আমি শিহরিত হই কপালে যখন তার নরম ঠোটের স্পর্শ পেলাম। আমি অবাক তখন তার দিকে চেয়ে। দেখি মোমের আলোয় মায়াবী একটা মুখ আমার দৃস্টির খুব কাছে, আমি কেপে ঊঠি। আমার ঘোর বাড়ে, দুহাতের জোরে খুব কাছে টেনে নিই তাকে। জাপটে ধরে রাখি তার শরীর। সে বাধা দেয়নি। শুধু মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে থাকে। আর আমার ঘোর বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।
ধন্যবাদ..... 👍👍👍
১।
সব মেয়ে ঘুমানোর আগে চুল বেধে ঘুমায়, এই মেয়ে রাতে চুল খোলা রেখে ঘুমায়। মেয়েটিকে নিয়ে আমার সারাদিন কোন অনুভুতিই কাজ করেনা, রাতে শুধু ঘুমাতে পারিনা, কারন এই মেয়ে রাতে চুল খুলে ঘুমায়,আমার চোখে তখন ঘোর লাগে।
.
মেয়েটির সাথে আমার বিয়ের তেরো দিনের মাথায় ওকে এখানে নিয়ে আসি। বিয়ের পরের সাতদিন বাবা মার সাথে ছিলাম, এরপর এখানে চলে আসা। আমার ইচ্ছে ছিলনা ওকে নিয়ে আসার, কিন্তু বাবা মা কথা শোনেননি আমার। তারা চায় ছেলে একা একা অনেক কস্ট করেছে খাওয়া থাকা নিয়ে, এখন আর না। বাধ্য হয়ে ওকে এখানে নিয়ে আসা। ওর সাথে আমার বিয়ে হয় মা বাবার ইচ্ছেতেই।
.
দেখতে গিয়ে ওর মধ্যে আহামরি আমি কিছুই পাইনি। গায়ের রং শ্যামলা, খুব সাধারন একটা সালোয়ার কামিজ পড়া ছিল, চুল বেনী করে রাখা, মুখে ক্রিম পাউডারের কোন অস্তিত্ব নেই, ত্বক মোলায়েম নয় আমি তা দূর থেকেই বুঝতে পারছিলাম। আমার ভালো লাগেনি কিছুই। কিন্তু মা বাবা কিভাবে এই মেয়েকে যেন পছন্দ করে ফেললেন। আমি না করেছিলাম, কিন্তু তারা আমার পিছ ধরেই রইলেন দিন দিন। অবশেষে তাদের ইচ্ছার কাছে হার মেনে নিলাম। আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।
আজ পর্যন্ত আমরা কাছাকাছি হইনি, আমার ইচ্ছে করেনি, মেয়েটির মধ্যেও আমি সেরকম কোন ইচ্ছে দেখিনি।
.
২।
সারাদিন অফিস করি, সন্ধ্যায় বন্ধু কলিগদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে, টিভিতে নিউজটা দেখে ঘুমাতে চলে যাই, সকালে নাস্তাটা সেরেই আবার বেড়িয়ে পড়ি।ওর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা হয়না। ছুটির দিনে আমার সকালে অনেক্ষন ঘুমানোর অভ্যেস, এই মেয়ে আমাকে ছুটির দিনেও রোজকার মত সকালে ডেকে নাস্তার জন্য বলে, আমার বিরক্ত লাগে, মনে হয় এক ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখি, পারিনা তাই মনের ইচ্ছা মনেই চেপে যাই। আমি এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি টেবিলে খাবার সেভাবেই পড়ে আছে, তার মানে এই মেয়েও খায়নি। মনে মনে ভাবি এতো ভালো আপদ গলায় ঝুলেছে! আমি নাস্তা করে, বারান্দায় সিগারেট ধরাতে গিয়ে দরজার ফাকে দেখি মেয়ে রান্নাঘরে খাচ্ছে। আমি ভাবি সিনেমেটিক ন্যাকামো।
ছুটির দিন গুলো অসহ্য ঠেকে আমার কাছে। আমার টিভি দেখার খুব নেশা নেই, ঘুম থেকে দেরীতে ওঠার কারনে দুপুরে ঘুমও আর আসেনা।
কি করবো বুঝিনা। আগে ছুটির দিনে বাড়ি চলে যেতাম, এখন মেয়েটিকে একা রেখে যাওয়া যাবেনা বলে বাড়িও যাইনা, ওকে নিয়ে যেতেও ইচ্ছে করেনা।এই মেয়েও আনইজি ফিল করে বোঝা যায়, টুকটাক কাজের বাহানায় দুরে দুরেই থাকে।তবু আমার বিরক্ত লাগে মনে, উটকো ঝামেলাই মনে হয়।
.
৩।
সেদিন সকালে অফিসে বের হবার সময় ও বলে, চাল নেই। দুপুরে হবে কিনা জিজ্ঞেস করি আমি, বলে দুপুরের রান্নার জন্যও হবেনা। রেগে গেলাম, চাল নেই এখন কেন জানাচ্ছে কাল জানায়নি কেন! চিবুকটা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ভুলে গিয়েছিলাম। বলে ওভাবেই দাড়িয়ে রইলো। আমি বের হয়ে গেলাম, রাগ নিয়েই, চাল কিনে আবার বাসায় আসবার সময় আমার নেই। ভাবলাম, না খেয়েই থাকুক একবেলা না খেলে কিছু হয়না। মনে খচখচানি ভাব রয়েই ছিল। সারা সকাল কাঠফাটা রোদের পর হঠাত করেই দুপুরের পর আকাশ মেঘলা হয়ে এল। অফিসে চাপটাও কমে এল, তাই সেদিন তারাতারিই বেরিয়ে গেলাম। চাল কিনে বাসায় জলদি ফিরে গেলাম। দরজায় বারবার নাড়া দিয়ে ভেতর থেকে কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা, আমার কাছে লক খোলার এক্সট্রা চাবি থাকে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি মেয়ে গভীর ঘুমে, সেই খোলা চুল, এলোমেলো শাড়ি। ইচ্ছে করে খুক খুক কাশি দিই আমি, ও ধরফর করে উঠে বসলো। এলোমেলো শাড়িটা কোন মতে থুপথাপ করে উঠে দাড়াতেই, মাথাটা চেপে আবার বিছানায় বসে পড়লো। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সামান্য নাকি জ্বর। চোখ দেখে মনে হলোনা জ্বরটা সামান্য। বাসায় থার্মোমিটার নেই, জ্বর কতটা ওষুধ লাগবে কিনা বুঝতে বাধ্য হয়েই কপালে হাত দিতে হলো। এই প্রথম ওকে স্পর্শ করেই অবাক হলাম, ভীষন জ্বর! দুপুরে কিছু খেয়েছে কিনা জানতে চাইলাম, চুপ করে বসে রইল। আমার একই সাথে খারাপ লাগছে আবার বিরক্তও লাগছে। ওকে শুয়ে থাকতে বলে আমি কাপড় পাল্টে রান্না ঘরে ঢুকলাম, একা থাকার কারনে টুকটাক রান্নার অভ্যেস আছে আমার।
ভাতটা রেঁধে নিচে গিয়ে ওষুধ এনে দিতে হবে, ভাবতে ভাবতে ঝমঝমিয়ে বৃস্টি। দড়জা দিয়ে দেখলাম ও দৌড়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে বোঝার জন্য পিছু পিছু আমিও এগিয়ে গেলাম, দেখি সে ধপ ধপিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ছাদে কাপড়। কাপড় তুলে আধভেজা হয়ে ফিরে এল। কাপড়ের পরিমান দেখে আন্দাজ করতে পারলাম জ্বরের কারন। বাসার সব কাপড় ধুয়েছে বলে মনে হল। রাগ হল তখন। কাপড় ধুয়ে জ্বর বাধিয়ে বসে আছে তার সেবা করবে কে! ভাবলাম ঝারি দেওয়া দরকার, তার যেমন ইচ্ছে সে সেভাবে চলবে নাকি! রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখি সে রুমে নেই। বারান্দায় শান্ত ভংগিতে কাপড় নাড়ছে, চুল খোলা। আমার সেদিন দিনের আলোতেই ঘোর লাগলো। ওই একরাতই শুধু আমার রাধতে হয়েছিল, পরদিন থেকে জ্বর নিয়েই সে টুক টুক করে সব কাজ করতো, আমার কিছু বলার ইচ্ছে হয়নি, কাজ করতে পারলে করুক! আমার দায়িত্ব ছিল ওষুধ কিনে দেওয়া আমি দিয়েছি, আর জিজ্ঞেসও করিনি জ্বর আছে কি নেই।
.
৪।
বছরের শেষের দিনগুলোতে অফিসে চাপ খুব কম থাকে। অযথা অফিসে বসে থাকতেও ভালো লাগেনা। মাঝে মাঝে দুপুর দুপুরেই বাসায় ফিরে যাই। সেদিন চাবি দিয়ে নিজেই দড়জা খুলে ঢুকেছি। ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে মেঝেতে বসে একমনে পায়ে আলতা সাজাচ্ছে, আমি পাশে দাড়ানো টেরও পায়নি। সরে এসে সামনে দাঁড়ালে চমকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে উল্টে ফেলে আলতার বাটি। কি যেন কি বড় অন্যায় করে ফেলেছে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আমি হেসে ফেললাম,সেই হাসিতে সে অবাক হয় , আমিও অবাক হই। সেদিন বাকি সময় দুজনই চোখ এড়িয়ে চলার চেস্টা করছিলাম।
.
আরেকদিন বাসায় এসে দরজা নেড়ে কোন শব্দ না পেয়ে নিজেই দড়জা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি রুম ফাকা, বারান্দাতেও কেউ নেই। আমার ভয় হয়। অচেনা শহর মেয়েটা যাবে কই! আরো ভয় হলো যখন মাথায় ভাবনা এল, আমাকে ছেড়ে চলে গেল নাতো! বাসা থেকে বের হইয়ে সিড়ি দিয়ে নামছি তখন মনে হল ছাদটা একবার দেখে যাই। গিয়ে দেখি মেয়ে, বিল্ডিং এর সব বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কানামাছি খেলছে। বাচ্চারা ওর কোমড়ের পেছনে লেগেছে। মেয়েটার খুব বেশি সুড়সুড়ি। ওর হাসি থামছেনা। মেয়েটি এভাবেও হাসতে জানে! আমার ঘোর লাগে।
.
৫।
প্রতিদিন আমার জলদি জলদি বাসায় ফেরার ইচ্ছে হয়, দুপুরের পর থেকে অফিসের চেয়ারটা আর ভালো লাগেনা, বন্ধু কলিগদের আড্ডাও আর ভালো লাগেনা। বাসায় ফিরে আসি, অলস বসে থাকি আড় চোখে ওকে খুজে বেড়াই। ও আগের মতই দূরে দূরেই থাকে। আমিও কিছু বলিনা। মা বারবার ফোন করে বাসায় যেতে বলে অস্থির করে ফেললেন। সেই যে বিয়ের পর এলাম আর যাওয়া হয়নি। মনে হল যাওয়া দরকার তখন। শুক্র শনি বন্ধ, বৃহঃষ্পতিবার বিকেল বিকেল করে বের হয়ে গেলাম। বৃহঃষ্পতিবার মানেই ভীড়। বাসে পাশাপাশি ফাকা কোন সিট পেলাম না। ওকে এক মহিলার পাশে বসিয়ে দিয়ে আমি পেছনে আরেকজনের সাথে শেয়ারে বসেছি। যতবার বাস থামে ততবার চাতকের মত দেখি ওর পাশে বসা মহিলা নেমে যায় কিনা। অর্ধেক পথ তখন চলে এসছি, সিট ফাকা হতেই আমি দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে বসি। দেখি মেয়ে ঘুম, চুল কিছু ক্ষোপার বাইরে অবাধ্য উড়ছে। আমি চোখ বুজে মুচকি হাসি। এর মধ্যে টুপ করে ওর মাথা এসে কাঁধে পড়ে। আমার হৃতস্পন্দন বাড়ে, আমার ঘোর লাগে। কাধ ঝাকি দিয়ে জাগিয়ে দিতেই দেখি মেয়ে লজ্জায় চুপসে গেছে।
.
৬।
বাসায় সারাদিন লোক লেগেই রইলো, নতুন বউ অনেকেই দেখেনি তারা দেখতে এল। মা ছেলের বউকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিচ্ছেন না, বউকেও দেখি মায়ের পিছ ছাড়ার ইচ্ছে নেই। বিকেলে দেখি মা তেল দিয়ে দিচ্ছে মাথায়, ওর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ছে। পানি নিয়েই মার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। আমি লুকিয়ে দেখি আমার ঘোর লাগে। মা যখন ছাড় দেয় ও তখন অথৈ সাগরে পড়ে, আমার ঘরে এসে কি করবে বুঝতে পারেনা, আবার অন্য রুমে গিয়ে একা বসলে মা কি ভাববে সেটা ভেবে অন্য কোথাও যেতেও পারেনা। সন্ধ্যায় বারান্দায় গিয়ে দেখি উদাস তাকিয়ে আকাশের দিকে। আমি জিজ্ঞেস, মার বাসায় যাবে? ও চমকে ওঠে। আমি অন্ধকারেও টের পাই ওর চোখ চিক চিক করছে। আমার ঘোর লাগে। আমি ছুটি ম্যানেজ করি আরো একদিনের। বাড়িতে গিয়ে ওর কি উচ্ছাস! নিজের ঘরটাতে ঢুকে সে কি কান্না! আমি বুঝতে পারিনা কি করবো, হা করে চেয়ে থাকি। অবাক চোখে দেখি দেয়ালে ছবিগুলো, মায়বী মুখের ছবিগুলো। সারাদিন সে বাসায় ছুটোছুটি করে বেড়ায়, আর একটু পর পর কিছুনা না কিছুর বাহানায় ঘরে এসে ঘুরে যায়, আমার কিছু লাগবে কিনা বোঝার চেস্টা করে। আমি প্রতিবার তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
.
৭।
আমার ছুটি শেষ। সবাই বলছিল ওকে রেখে যাই যেন কিছুদিনের জন্য, আমি মুখে সায় দিচ্ছিলাম কিন্তু রাগ হচ্ছিল প্রত্যেকের উপর খুব। ও যদি রাজি হয়ে যায়, সেই ভয়ে আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে তখন। থাকতে রাজি হয়নি। ফিরতি পথে আমি চাইতে লাগলাম ও আবার সেদিনের মত ঘুমিয়ে যাক আর মাথাটা আবার আমার কাধে এসে পড়ুক। আমি বিচক্ষনে ওর একটু পাশে সরে আসতেই বুঝলাম ও কাঁদছে। আমার রাগ হল খুব, কেন কাদছে ও, আমাকে কি ভালো লাগেনা! যত পথ শেষ হয়ে আসছিল, মেঘ তত গভীর হয়ে জমাট বাধছিল আকাশে। ঘোর বৃস্টির মধ্যে বাস থেকে নামলাম আমরা। রিক্সায় উঠতে উঠতেই তখন ভিজে একাকার। হুড তুলে খুব পাশাপাশি দুজনে বসে আছি। তাতেও আমার রাগ কমছে না।
.
৮।
আমার বৃস্টি ভালো লাগেনা, ছোট বেলা থেকেই বৃস্টিতে ভেজার অভ্যেস নেই। বৃস্টির পানি মাথায় পড়া মাত্র আমার জ্বর ঠান্ডা ধরে বসে। সেদিনো ব্যাতিক্রম হলো না। হাড় কাপিয়ে জ্বর এল আমার। সেদিন বুঝতে পারলাম একটা মেয়ে কতটুকু মায়া তার ভেতরে লালন করে! জ্বরের পর থেকে মুহুর্তের জন্যও সে আমার পাশ থেকে সরেনি। আমার তাকিয়ে থাকতে কস্ট হচ্ছিল, তবুও যতবার চোখ খুলে তাকিয়েছি দেখেছি ও উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়েই আছে মুখের দিকে। ওর স্পর্শ আর উদ্বেগ পাওয়ার জন্যই মনে হয় আমার জ্বর আরো জেকে বসছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে জ্বর আরো বাড়লো, সব কিছু আস্বভাবিক, আলো চোখের পাতা ভেদ করে চোখে গিয়ে লাগছিল।
.
বেহুশের মত কতক্ষন পড়ে ছিলাম জানিনা, শেষরাতের দিকে যখন চোখ খুললাম আলো আর চোখে এসে বিধলো না। দেখি ঘরে মোম জ্বলছে।
ক্লান্তিতে চোখ খুলে রাখা খুব কস্টের তখন। চোখ বুজে মরার মতই পড়ে রইলাম। কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম নরম হাত আমার কপাল বেয়ে বার বার চুলে হাত বুলাচ্ছে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি মায়ায়। আমি শিহরিত হই কপালে যখন তার নরম ঠোটের স্পর্শ পেলাম। আমি অবাক তখন তার দিকে চেয়ে। দেখি মোমের আলোয় মায়াবী একটা মুখ আমার দৃস্টির খুব কাছে, আমি কেপে ঊঠি। আমার ঘোর বাড়ে, দুহাতের জোরে খুব কাছে টেনে নিই তাকে। জাপটে ধরে রাখি তার শরীর। সে বাধা দেয়নি। শুধু মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে থাকে। আর আমার ঘোর বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।
ধন্যবাদ..... 👍👍👍
No comments